ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই। কুমারজীবন,
দুনিয়াবিমুখতা ও সংসার-বিরাগ অশোভনীয় কাজ। এখানে
গিরিগুহা কিংবা মসজিদে বসে আল্লাহর নাম জপ করায়
পৌরুষ নেই। বরং জীবনের টানাপড়েন, বাজারের
শোরগোল ও কারবারের ব্যস্ততার মধ্যেও
আল্লাহকে ভুলে না-যাওয়া পৌরুষের পরিচয়। এই
ধর্মে কেবল আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর ইবাদতের কথাই
বলা হয়নি; বরং নামাজের পর জীবিকা অন্বেষণের
প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের ভাষায়-
'সলাত সম্পন্ন হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে
পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করো।'
(সুরা জুমা : ১০)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ ﴾ﷻ﴿ বলেন,
'পরকালীন জীবনে আল্লাহ আপনাকে যা দান
করবেন, আপনি তা অনুসন্ধান করুন। কিন্তু পার্থিব
জীবনে আপনার ন্যায্য অংশের কথা আপনি ভুলে
যাবেন না।'
(সুরা কাসাস : ৭৭)
নিজ হাতে কামাই-রোজগার ও হালাল উপার্জনের
নির্দেশ কেবল সাধারণ মুসলমানদেরই দেওয়া হয়নি;
বরং যুগে যুগে সব নবী-রাসুলগণ এ ব্যাপারে আদিষ্ট
ছিলেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ ﴾ﷻ﴿ বলেন,
'হে রাসুলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করুন এবং
নেক কাজ করুন।'
(সুরা মুমিনুন : ৫১)
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
যুগে যুগে এ নির্দেশনা মোতাবেক নবী-রাসুলগণ
নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করেছেন।
আদম (আ.) কৃষিকাজ ও তাঁতের কাজ করেছেন।
ইদরিস (আ.) দর্জির কাজ করেছেন।
হুদ ও ছালেহ (আ.) ব্যবসায়ী ছিলেন।
ইব্রাহিম ও লুত (আ.) কৃষি পেশা গ্রহণ করেছিলেন।
শুয়াইব (আ.) পশু বিচরণ করেছেন এবং বাজারে
এগুলোর দুধ বিক্রি করতেন।
দাউদ (আ.) লোহা দিয়ে নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি
করতেন।
প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﴾ﷺ﴿ বকরি পালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য
করেছিলেন।
ইসলামী শরিয়তে নিজ হাতে উপার্জিত খাবার
গ্রহণে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছেঃ
হাদিস এসেছে, রাসুল ﴾ﷺ﴿ বলেন,
'নিজ হাতে উপার্জিত খাবার থেকে উত্তম কোনো
খাবার নেই; আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে
উপার্জিত খাবার খেতেন।'
(বুখারি : ২০৭২)
অন্য হাদিসে এসেছে,
'ইমান আনার পর হালাল উপার্জন অন্যতম কর্তব্য।'
(শুআবুল ইমান : ৮৩৬৭)
মানবজীবনে অর্থ-সম্পদের প্রয়োজনীয়তা এবং
ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণেই রাসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿
হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের যত পথ ও পন্থা
আছে, সেগুলো অবলম্বনে উৎসাহিত করেছেন।
কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে।
আল্লাহর রাসুল ﴾ﷺ﴿ বলেছেন,
'কোনো মুমিন যখন গাছ লাগায় অথবা কৃষিজ ফসল
ফলায়, অতঃপর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা পশু
আহার করে; সেটি তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য
হবে।'
(বুখারি : ২৩২০)
ব্যবসার ক্ষেত্রে মহানবী ﴾ﷺ﴿ বলেছেন,
'সততা ও সত্যবাদিতা নিয়ে যারা ব্যবসায় পরিচালনা করবে,
তারা কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের
সঙ্গে উঠবে।'
(তিরমিজি)
শিল্প ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ একইভাবে
উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। সে কারণেই
রাসুলের জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামের একটা বিরাট
দল ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, কৃষি ও শিল্পে
নিজেদের দক্ষতার গুণে বিপুল ধনৈশ্বর্যের মালিক
হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের কেউ কেউ রাসুল ﴾ﷺ﴿
থেকে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদও
পেয়েছিলেন।
হজরত ওসমান (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.),
সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)- এ রকম অনেক
সম্পদশালী সাহাবির নাম ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে।
বৈষয়িক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়,
বরং হালাল উপায়ে সম্পদসম্ভার উপার্জন করে আল্লাহর
নির্দেশিত পথে পার্থিব জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে
বিচরণই আসল ধার্মিকতা।
তাই তো রাসুলুল্লাহ ﴾ﷺ﴿ বলেছেন,
'দুনিয়াটা আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।'
রাসুল ﴾ﷺ﴿ - এর যুগে ব্যবসায়িক কার্যক্রমঃ
রাসুল ﴾ﷺ﴿ আল্লাহর ইবাদত তথা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান
শিক্ষা ও চর্চা এবং দ্বীনি দাওয়াতের জন্য মদিনায় মসজিদ
নির্মাণ করেছেন, তেমনি মানুষের অর্থনৈতিক
কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মদিনায় তিনি ইসলামী বাজার
প্রতিষ্ঠা করেছেন। বনু কায়নুকার বাজারটির পরিচালনার
দায়িত্বভার তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। এ বাজারটির বৈশিষ্ট্য
ছিল- এখানে কোনো রকম ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি,
মাপে কম-বেশি করার বা পণ্যদ্রব্য মজুদ অথবা আটক
করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট
দেওয়ার সুযোগই ছিল না।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.)
সূত্রে বর্ণিত, রাসুল ﴾ﷺ﴿ একদিন এক বিক্রেতার
খাদ্যের স্তূপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি
তাঁর হাত ওই খাদ্যের স্তূপে প্রবেশ করান, এতে তাঁর
হাত ভিজে গেল এবং অনুপযুক্ত খাদ্যের সন্ধান
পেলেন।
তখন রাসুল ﴾ﷺ﴿ ইরশাদ করলেন,
'হে খাদ্য বিক্রেতা! এগুলো কী?' তখন সে বলল,
হে আল্লাহর রাসুল! খাদ্যগুলো বৃষ্টিতে ভিজে
গেছে। রাসুল ﴾ﷺ﴿ ইরশাদ করলেন, 'তুমি এই ভিজা
খাদ্যগুলো ওপরে রাখোনি কেন, যাতে সবাই তা
দেখে নিতে পারে? যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা
দেবে সে আমার উম্মত নয়।'
(মুসলিম : ১০২)
ওজনে কম দেওয়া সম্পর্কে আল্লাহ্ ﴾ﷻ﴿ বলেন,
'যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য রয়েছে বহু
দুর্দশা, যারা মানুষের কাছ থেকে নেওয়ার সময় পূর্ণ
মাত্রায় নেয়, আর যখন অন্যকে ওজন করে দেয়
তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদের এক
মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সব
মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে।'
(সুরা মুতাফি্ফফীন, আয়াত : ১-৬)
ব্যবসা করা ইসলামে সুন্নত ও সৎকর্ম বলে গণ্য
হলেও সব ধরনের ব্যবসা ইসলামে বৈধ নয়। যে
ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি,
মুনাফাখোরি, কালোবাজারি এবং হারাম জিনিস যেমন-
মাদকদ্রব্য, শূকর, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদির ব্যবসা
ইসলামে হারাম।
নবী করিম ﴾ﷺ﴿ একদিন সালাতের জন্য বের হয়ে
দেখতে পেলেন, লোকজন কেনাবেচা
করছে। তখন তিনি তাদের ডেকে বলেন, 'হে
ব্যবসায়ী লোকেরা! কিয়ামতের দিন কিছু ব্যবসায়ী
মহা পাপীরূপে উঠবে; তবে তারা নয়, যারা
আল্লাহকে ভয় করবে, সততা, বিশ্বস্ততা সহকারে
ব্যবসা করবে।'
(তিরমিজি, হা. ১২১০)
অন্য হাদিসে রাসুল ﴾ﷺ﴿ ইরশাদ করেন,
'হে ব্যবসায়ীরা! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার
থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।'
(তিবরানি)
পণ্যে ভেজাল মেশানো গর্হিত কাজঃ
পণ্যে ভেজাল মেশানো আমাদের দেশের
অন্যতম সামাজিক অপরাধ। ভেজাল বলতে কেবল
পণ্যসামগ্রীতে বর্জ্যপদার্থ, ভিনজাতীয় পদার্থ বা
বিষ মেশানোকেই বোঝায় না; বরং ব্যবসায়িক
লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়ে বস্তুর দোষত্রুটি
গোপন করা, ওজনে কম দেওয়া, মিথ্যা তথ্য দেওয়া,
ধোঁকা দেওয়া, আসল কথার বিপরীত করা,
ভালোমানের পণ্যে নিম্নমানের পণ্য মিশ্রণ,
মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি ভেজালের
অন্তর্ভুক্ত। আর সব ধরনের ভেজাল মিশ্রণ
ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহ্ ﴾ﷻ﴿ বলেন,
'হে আহলে কিতাবগণ! কেন তোমরা জেনেশুনে
সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে সংমিশ্রিত করছ এবং সত্যকে
গোপন করছ।'
(সুরা আলে ইমরান : ৭১)
রাসুল ﴾ﷺ﴿ ইরশাদ করেন,
'যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার
উম্মত নয়।'
(মুসলিম : ১০২)
তিনি আরো বলেছেন,
'যদি তোমার পণ্যদ্রব্যে কোনো দোষ থাকে,
তবে তা কখনো গোপন করবে না। কেননা তা
গোপন করলে ব্যবসায় বরকত আসে না।'
(বুখারি ও মুসলিম)।
অন্য হাদিসে এসেছে,
'যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রি করে,
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে ফিরে তাকাবেন
না।'
(সহিহ বুখারি)
মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সম্পর্কে ইসলামের বিধানঃ
খাদ্যদ্রব্য মজুদ করা অথবা তা বাজার থেকে তুলে
নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করাকে
ইসলাম অবৈধ করেছে। হানাফি মাজহাব মতে তা মাকরূহে
তাহরিমি (হারাম সমতুল্য) হলেও অন্যান্য মাজহাব মতে এটি
হারাম। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়
এবং অনেক মানুষ দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়। এ ধরনের
কাজ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। তাই ইসলাম এ
প্রকার কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে।
এ প্রসঙ্গে রাসুল ﴾﴿ বলেন,
'যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে,
আল্লাহপাক তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।'
(আবু দাউদ : ৫৫)
ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে
বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ।
রাসুল ﴾ﷺ﴿ বলেছেন,
'যে খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অভিশপ্ত।'
(ইবনে মাজাহ)
তিনি আরো বলেন,
'যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে
আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।'
(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬)
অন্য হাদিসে এসেছে :
'যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।'
(আল মু'জামুল কাবির : ১০৮৬)
তবে গুদামজাত পণ্য যদি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয়
বস্তু না হয় কিংবা মানুষ এর মুখাপেক্ষী না হয় অথবা এসব
পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত হয় বা গুদামজাতকারী বর্ধিত মুনাফা
অর্জনের অভিলাষী না হয়, তাহলে এসব অবস্থায়
পণ্য মজুদ রাখা অবৈধ নয়।